বন্ধ হয়ে পড়েছে ৮০ ভাগ নির্মাণকাজ


বন্ধ হয়ে পড়েছে ৮০ ভাগ নির্মাণকাজ

অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে দেশের নির্মাণসামগ্রীর মূল্য। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৮০ ভাগ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে প্রতিবছর মূল্য সমন্বয় করা হয় বলে মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় এক বছর ধরে নির্মাণসামগ্রীর বাজার অস্থির। লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে। স্বাভাবিক নিয়মে প্রায়ই নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ে। সেটার একটা সহনীয় অবস্থা থাকে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এটা অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছে। সম্প্রতি দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইট, বালু, পাথর, রড, সিমেন্ট, রেডি মিকস, বিটুমিন এবং লোহাজাতীয় সব জিনিসের দাম উপকরণভেদে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

কিন্তু দরপত্রের সময় নির্ধারিত দরেই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়া না হলে ঠিকাদারদের কাজ গুটিয়ে নিতে হবে। আর এ খাতে যেসব মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে, তারাও ঝুঁকিতে পড়বে। ২০০৭ সালে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে তৎকালীন সরকার নির্মাণ উপকরণের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করেছিল। এতে ওই সময়ের ঠিকাদার বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল অঙ্কের আর্থিক থেকে বাঁচতে পেরেছিল। তখন এমন সিদ্ধান্ত না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণখেলাপি হয়ে পড়ত। বেশিরভাগ লোককেই পেশা ছেড়ে যেতে হতো। বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

আরও জানা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ছিল ৪৫০ থেকে ৪৬০ টাকা; আর এখন ৫২০ থেকে ৫৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ৮ হাজার টাকার ইটের গাড়ি এখন ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ২ হাজার ২০০ টাকার বালুর গাড়ি ২ হাজার ৭০০ টাকা, রডের টন ৬৮ হাজার টাকার স্থলে এখন কিনতে হচ্ছে ৮৮ হাজার টাকায়।

এছাড়া রেডিমিকস সিএফটি ৩৫০ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৩৮৫ টাকা, পাথরও গাড়িতে বেড়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, টনপ্রতি বিটুমিনের দাম ৪৮ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬ হাজার টাকা। শ্রমিকদের মজুরি ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দিতে হচ্ছে। অতিমাত্রায় বেড়েছে গাড়িভাড়াও। সরকার চলতি বছরের নির্মাণ উপকরণের যে রেট প্রকাশ করেছে, বাজার মূল্য তার চেয়েও অনেক বেশি। অথচ অনেকের কাজ নেওয়া রয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের রেট অনুযায়ী। আইনি জটিলতা থাকায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এ বিষয়টি সমাধানে সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরিপত্র জারি করতে পারে। নইলে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন আরও বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয় প্রতিষ্ঠান-বাংলাদেশ কনন্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এবং এফবিসিসিআইর পরিচালক (ঠিকাদারি সংস্থাবিষয়ক) মো. জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রায় ৮০ ভাগ উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে পড়েছে। বিষয়গুলো ভুক্তভোগী সবাই আমাদের অবহিত করেছেন। এই বিষয়টি এফবিসিসিআইর ঊর্ধ্বতন নেতাদের জানানো হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রায় ৫০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ থমকে গেছে। নির্মাণ উপকরণের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আপাতত কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। একই চিত্র জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলোর। এ সংস্থার তত্ত¡াবধানে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কাজ সচল রাখতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ সচল রাখতে চাপ প্রয়োগ করলেও তারা কাজ করছেন না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), গৃণপূর্ত অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার উন্নয়ন কাজগুলোর একই চিত্র বিরাজ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর এখন ঊর্ধ্বগতি। এটা স্থির না হওয়া পর্যন্ত সরকারের এখানে কিছু করার নেই। কেননা সরকার এখন একটা নির্ধারণ করবে। কদিন পর সেটা আবার বেড়ে যাবে। এজন্য বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী মহোদয় ও প্রধান প্রকৌশলী ঠিকাদারকে চাপ প্রয়োগ করছেন। ঠিকাদাররা কীভাবে এসব কাজ করবে। তারা কি তাদের বাড়ি, জায়গা-সম্পদ বিক্রি করে এসব করবে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিষয়গুলো ভেবে নির্মাণসামগ্রীর একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে চলমান কাজগুলোর ক্ষেত্রেও সেটা কার্যকর হবে ওই পরিপত্রে এমন নির্দেশনা থাকতে হবে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে এসএম রহমান ইন্টারন্যাশনাল নামের এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শেখ মুজিবুর রহমান বাবু যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণ উপকরণের দাম যে হারে বাড়ছে, চলমান কাজগুলা শেষ করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। দফায় দফায় নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর এখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সব ধরনের নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়েছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্টের বিধান অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলো চাইলেই নির্মাণ উপকরণের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার ডরমেটরি ভবন নির্মাণের কাজ করছে আসিফ ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুল হাই। তিনি বলেন, ওই ভবনের দরপত্র চ‚ড়ান্ত হওয়ার আগেই সরকার ২ ভাগ ভ্যাট বাড়ায়। সেটাও সমন্বয় করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এরপর দফায় দফায় নির্মাণ উপকরণের মূল্য বেড়েছে। সবশেষ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এখন এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিষয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য সমন্বয় করে কোনো পরিপত্র জারি না করলে বর্তমান সরকারের সময়ে চলমান উন্নয়নযজ্ঞ থমকে যাবে। বিষয়গুলো আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি, সরকার এ ব্যাপারে ২০০৭ সালের মতো নির্মাণ উপকরণের মূল্য সমন্বয় করে নতুন মূল্য নির্ধারণের নির্দেশনা প্রদান করবে। এটা না হলে দেশের উন্নয়ন কাজের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়বে।

জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম) কামাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে আবাসন ব্যবসায়ীরাও মারাÍক চাপের মুখে পড়ছে। নির্মাণ উপকরণের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি, পরিবহণ খরচও সমানতালে বেড়েছে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে দেশের উন্নয়ন ও নির্মাণ খাতের মুখ থুবড়ে পড়বে।


আরো পড়ুনঃসিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনে নৌপথই একমাত্র ভরসা

0