৮০ মিনিটে পুরোনো লোহা যেভাবে রড হয়ে যায়


৮০ মিনিটে পুরোনো লোহা যেভাবে রড হয়ে যায়

চুল্লিতে দাউ দাউ করে জ্বলছে পুরোনো লোহার টুকরা। ১ হাজার ৬০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় লোহার টুকরো গলে পানির মতো তরলে পরিণত হচ্ছে। এভাবে দুই ধাপে অনেকক্ষণ পরিশোধন করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় বিশুদ্ধ তরল লোহা। এই তরল লোহা আরেক ধাপে রূপ নেয় উত্তপ্ত বিলেটে। আর বিলেট উত্তপ্ত থাকা অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কারখানায় অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে রড আকারে। সব মিলিয়ে সময় লাগে ৮০ মিনিট।

এদিকে রড তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কারখানার শেষ প্রান্তে তা ক্রেনের সাহায্যে অপেক্ষমাণ গাড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আর গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। সম্প্রতি সরেজমিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিয়ায় অবস্থিত জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। বিশ্বে দ্বিতীয় এবং এশিয়ায় প্রথম এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রড তৈরি করছে দেশের অত্যাধুনিক কারখানাটি।

নতুন প্রযুক্তিতে রড উৎপাদনের পদ্ধতি দেখাতে সম্প্রতি একদল সাংবাদিককে জিপিএইচের নতুন কারখানায় নেওয়া হয়। কারখানাটি ঘুরে দেখানোর পর কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবও দেন তাঁরা।

সাংবাদিকেরা কারখানাটি পরিদর্শনের সময় জিপিএইচের কর্মকর্তারা জানান, ‘কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ও উইনলিংক’ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ৮ মিলিমিটার ব্যাসের রড তৈরি করা যায় মাত্র ৮০ মিনিটে। প্রচলিত পদ্ধতিতে এত কম সময়ে ও সরাসরি রড তৈরি সম্ভব নয় বলে জানান তাঁরা। কর্মকর্তারা বলেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিকর সালফার ও ফসফরাস সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। তাতে উচ্চশক্তির রড তৈরি করা যায়। রডের মানও হয় বিশুদ্ধ। তবে কারখানাটিতে এখন ৮ থেকে ৫০ মিলিমিটার ব্যাসের রড উৎপাদন হচ্ছে। গ্রাহকের চাহিদানুযায়ী ইস্পাতের নানা পণ্যও সরবরাহ করছে এই প্রতিষ্ঠান। আবার দেশের বিশেষায়িত প্রকল্পেও রড সরবরাহ শুরু করেছে জিপিএইচ।

কারখানা ঘুরে আসার পর জিপিএইচ ইস্পাতের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, রড তৈরির সময় সালফার ও ফসফরাস যত কম রাখা যায় মান ততই ভালো হয়। ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ও উইনলিংক প্রযুক্তি ছাড়া এই সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আবার প্রচলিত রডের চেয়ে কোনো স্থাপনায় উচ্চশক্তির রড ব্যবহার হলে খরচও কমে যায়। এর কারণ হলো, তাতে রড কম লাগে। টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিশ্বের অনেক দেশে এই প্রযুক্তিতে তৈরি রড ও ইস্পাত পণ্য ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে।

কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ সালে এই কারখানাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০২১ সালের ২১ জুন থেকে। নতুন এই কারখানায় বছরে ৮ লাখ ৪০ হাজার টন বিলেট ও ৬ লাখ ৪০ হাজার টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। নতুন ও পুরোনো কারখানা মিলিয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়িয়েছে বিলেট ১০ লাখ টন এবং রড ৭ লাখ ৬০ হাজার টনে। সক্ষমতা অনুযায়ী ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। নতুন কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

নতুন এই কারখানা চালু হওয়ার পর দেশে রড উৎপাদন সক্ষমতায় শীর্ষে তিনে উঠে এসেছে জিপিএইচ। রড উৎপাদন ক্ষমতায় এখনো শীর্ষে রয়েছে বিএসআরএম। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আবুল খায়ের গ্রুপ (একেএস)। তৃতীয় অবস্থানে জিপিএইচের সঙ্গে কেএসআরএমও রয়েছে। আবুল খায়ের গ্রুপের হাত ধরে এক যুগ আগে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে উৎপাদন শুরু হয় এ দেশে। জিপিএইচ একই প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সংস্করণের সঙ্গে উইনলিংক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে।

জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ইস্পাত পণ্য উৎপাদন করে চীন। আর সেই চীনেই এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার টন বিলেট (রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল) রপ্তানি করেছে জিপিএইচ। গুণগতমানের পণ্য উৎপাদনের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। শুধু গুণগত মানেই নয়, এই প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধবও।


আরো পড়ুনঃঢাকায় শুরু হলো কিচেন বাথ অ্যান্ড লিভিং এক্সপো ২০২৩

0