সিমেন্ট শিল্পে কার্বন নিঃসরণ, বিকল্প উদ্যোগ জরুরি


কংক্রিটের প্রধান উপাদান সিমেন্ট আমাদের পরিবেশের বড় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা জানি কি সিমেন্ট বা কংক্রিট উৎপাদন প্রক্রিয়া আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কার্বন নিঃসরণে কতটা ভূমিকা রাখছে? যুক্তরাজ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বে যত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় তার আট শতাংশের উৎস এই সিমেন্ট বা কংক্রিট। যদি কংক্রিটকে একটি দেশ ধরা হয় তাহলে সেটি হতো বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশ যার অবস্থান হতো চীন এবং আমেরিকার পরেই।

সিমেন্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সবচেয়ে বেশি দায়ী হিসেবে ধরা হয়।

গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছে জলবায়ু এবং বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে হুমকির মুখে রয়েছে অনুন্নত এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাসকারী মানুষজন। পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলো সাশ্রয়ী এবং টেকসই সমাধানের পথ খুঁজছে। অনেকের ধারণা, সিমেন্ট আধুনিক যুগের একটি নির্মাণ সামগ্রী যা সাম্প্রতিককালে খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে। যদিও গবেষকদের মতে এর ব্যবহার চলে আসছে গত কয়েক হাজার বছর ধরে।

সিমেন্ট উৎপাদন করতে গিয়ে কাঁচামাল হিসেবে প্রাথমিক ধাপে ব্যবহার করা হয় চুনাপাথর (লাইমস্টোন) এবং মাটি। এগুলোকে প্রথমে চূর্ণ করা হয়, তারপর ঢুকানো হয় বিশাল আকৃতির সিলিন্ডারের ভেতর। সেখানে ১৪০০-১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মিশ্রণটিকে উত্তপ্ত করা হয় যাকে বলা হয় ক্যালসিনেশন। উচ্চ তাপমাত্রায় উপাদানগুলো ভেঙে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় ক্লিংকার। ক্লিঙ্কার ঠান্ডা করে মেশানো হয় জিপসাম ও চুনাপাথর। সঙ্গে আনুপাতিক হারে মেশানো হয় লোহার আকরিক অথবা ছাই যেগুলো স্ল্যাগ এবং ফ্লাইঅ্যাশ নামে বেশি পরিচিত। এরপর মিশ্রণটিকে একটি বলমিলের ভিতরে চূর্ণ করে তৈরি হয় সিমেন্ট।

এখন প্রশ্ন হলো, কার্বন নিঃসরণের জন্য কীভাবে দায়ী এই সিমেন্ট? বিজ্ঞানীদের মতে, ক্লিংকার তৈরি থেকে শুরু করে সিমেন্ট বা কংক্রিট তৈরির এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। কংক্রিট যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে তার অর্ধেক নিঃসরিত হয় সিমেন্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম কার্বনেটের প্রতিক্রিয়ায় আর বাকি অর্ধেক হয় জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বালিয়ে ক্লিংকার উৎপাদনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানি সিলেটের লার্ফাজ সুরমা ছাড়া বাকি সব উৎপাদকই আমদানি করা ক্লিকারে ওপর নির্ভরশীল। আমাদের মতো অনেক দেশের চাহিদার যোগান দিতে বিপুল পরিমাণ ক্লিংকার উৎপাদনে বৈশ্বিক জলবায়ুর ওপর প্রভাব পড়ছে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের অনেক সুচকের মধ্যে নির্মাণ বা অবকাঠামো খাত অন্যতম। মাথাপিছু বাৎসরিক সিমেন্ট ব্যবহারে যদিও বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে, তারপরও সামগ্রিক সূচকে বিশ্বে সিমেন্ট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকেই থাকে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট ব্যবহার হয় চীনে যা মাথাপিছু ১ হাজার ৮০০ কেজি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে মাথাপিছু ৩২০ কেজি এবং মিয়ানমারে ২৮০ কেজি। সে হিসেবে মাথাপিছু মাত্র ২০০ কেজি সিমেন্টের ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে হলেও আয়তনের হিসেবে আমাদের এই ছোট্ট দেশটির বার্ষিক চাহিদা প্রায় তিন কোটি মেট্রিক টন সিমেন্ট। যদিও আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে দেশে সক্রিয় ছোট-বড় ৩৭ সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদার ২০-২৫ শতাংশ যায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে, ১০-১৫ শতাংশ ব্যবহার হয় শিল্প কারখানা তৈরিতে এবং বাকি প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণে। বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদন করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ যোগান দেয় দেশীয় কোম্পানিগুলো।

নির্মাণ শিল্পে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হার কমিয়ে আনতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং নামি-দামি কোম্পানিগুলো বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। কিছু কিছু কোম্পানি ইতোমধ্যে কার্বন নির্গমন উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে এনেছে। ‘নেট-জিরো’ বলতে একটি শব্দ বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করতে শোনা যায়। এর মানে হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। উন্নত দেশগুলোও এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে এই লক্ষ্যকে সফল করতে। তারা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে।

উৎপাদন এবং বিক্রয় উভয়ক্ষেত্রে বিপুল হারে প্রবৃদ্ধি হলেও, মানসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব সিমেন্ট বা টেকসই  কংক্রিট উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়েছে খুব সামান্যই। অন্যতম উৎস হলেও সরকারি বা বেসরকারিভাবে সিমেন্ট শিল্পের কার্বন নির্গমন রোধ বা কমানোর কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। বিশ্বে বিকল্প উপায়ে সিমেন্টের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশীয় উৎপাদকদের তেমন কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে বহুজাতিক কিছু কোম্পানি সীমিত আকারে পরিবেশ বান্ধব সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করেছে। অন্যদিকে একেবারে হাতে গোণা দেশীয় কিছু উৎপাদকও ক্লিংকারের পরিমাণ কমিয়ে স্ল্যাগ বা লাইমস্টোন ব্যবহার বাড়িয়ে নতুন ধরনের সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করেছে যা অপ্রতুল হলেও প্রশংসার দাবি রাখে।

আরো পড়ুনঃ আগামীকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াসে যাত্রা শুরু আকিজ বশির গ্রুপের

বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো যে প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গমন কমাচ্ছে তা আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো অনুসরণ করতে পারে। এর মধ্যে তিনটি উদ্যোগ খুব আলোচিত হচ্ছে।

. গ্রিন কংক্রিট: বিশ্বে নির্মাণ খাতে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘গ্রিন-কংক্রিট’। এই কংক্রিটের জন্য সিমেন্ট ক্লিংকার কমিয়ে বিকল্প কাঁচামাল যেমন: স্ল্যাগ এবং লাইমস্টোন বেশি দিয়ে উৎপাদন করা হয়। তা ছাড়া গ্রিন কংক্রিটে খুব কম পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, যাতে ন্যূনতম কার্বন নিঃসরণ হয়। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব  হিসেবে বিবেচিত বিকল্প কাঁচামালগুলো বিভিন্ন ভারী শিল্প যেমন: স্টিল মিল এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। কাজেই এইরকম কয়েকটি কাঁচামাল বিবেচনায় নেওয়া যায় যেমন: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া ফ্লাইঅ্যাশের ব্যবহার বাড়ানো, স্টিল শিল্পের অ-লৌহ উপাদান স্ল্যাগের ব্যবহার বাড়ানো, ফাইবার গ্লাস বা গ্লাসের বর্জ্য, ধান থেকে তৈরি হওয়া ছাই, পোড়া মাটি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ক্লিংকার যেহেতু পুরোপুরি আমদানি নির্ভর কাজেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েরও সুযোগ হবে।

দেশে ঘরবাড়ি নির্মাণে কম ফ্লাইঅ্যাশ এবং বেশি ক্লিংকারের সিমেন্টের প্রতি ক্রেতাদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়। তাদের অনেকের ধারণা ফ্লাইঅ্যাশ দিয়ে তৈরি সিমেন্টে স্থাপনা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এই ধারণাটি বদলাতে হবে। তাদের জানাতে হবে গ্রিন কংক্রিটের বিল্ডিংয়ে ব্যবহারযোগ্য জায়গা বেশী থাকে, স্থাপনা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, আগুনের বা সূর্যের তাপ শোষণ ক্ষমতা বেশি থাকে। সর্বোপরি, গ্রিন কংক্রিটের ভবন লবণসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক দ্রব্য থেকে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেয়।

. কংক্রিটের রিসাইক্লিং: আমাদের দেশে এখনো এই ধারণাটি প্রচলিত নয়। উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কংক্রিট রিসাইক্লিং করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এতে ক্লিংকার বা সিমেন্ট উৎপাদন কম হয়, ফলে কার্বন নির্গমনও কমে যায়।

. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা বর্জ্য পুনর্ব্যবহার: বহুজাতিক কিছু কোম্পানি এখন অন্যান্য খাতের বিভিন্ন শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে হাত দিচ্ছে। তারা বিভিন্ন শিল্প যেমন: গার্মেন্টস, খাদ্যপণ্য এবং কৃষি খাতের বিভিন্ন বর্জ্য সংগ্রহ করে এবং যৌথ খরচে প্রক্রিয়াকরণ করে পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা নানান কাজে ব্যবহার করছে এবং সিমেন্ট উৎপাদনেও কাজে লাগাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে আমাদের দেশে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা উচিত।

কাজেই সরকারি এবং বেসরকারিভাবে ক্লিংকারের পরিমাণ কমিয়ে বিকল্প কাঁচামাল ব্যবহার, গ্রিন কংক্রিট বা গ্রিন বিল্ডিংকে উৎসাহিত করা, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী উৎপাদকদের প্রণোদনা দেওয়া এবং নির্মাণকারীদের পরিবেশের বিষয়ে আরও সচেতন করার মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারি।

আমাদের উচিত এখনই কাজ শুরু করা যাতে দেশীয় সিমেন্ট উৎপাদন বা কংক্রিট শিল্পে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা যায়। অন্যথায় উন্নত দেশগুলো একসময় কার্বন নিঃসরণ তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দায় আমাদের উপরও চাপাবে এবং জলবায়ু সম্পর্কিত সাহায্য সহযোগিতাও কমে যেতে পারে। আশা করি সরকার ও উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

 

মো. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী: সিমেন্ট বিপণন নির্বাহী, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ বিষয়ে আগ্রহী।

Source: The Daily Star

0