বাংলাদেশের পেইন্ট শিল্পঃ বর্তমান প্রবণতা


পেইন্ট প্রস্তুতকারীদের মতে পৃথিবির সবচেয়ে ঘন – বসতি এলাকা হিসেবে পরিচিত দক্ষিন এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল – প্রবৃদ্ধির এলাকার অন্যতম। এই অঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যা এবং দ্রুত নগরায়ন পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারারদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা বয়ে এনেছে।

প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশের পেইন্ট মার্কেট গত দশক জুড়ে ভাল প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। যদিও ২০১৯ এবং ২০২০ প্রথমার্ধ এ দেশের পেইন্ট শিল্পের জন্য ভাল ছিল না। এই বছর দেড়েক জুড়ে মন্দার পরও বিভিন্ন পেইন্ট কোম্পানীর নেয়া বিনিয়োগের সিদ্বান্ত, এর ঘোষনা এবং সে মোতাবেক কর্মকান্ড দেখেছে।

জাপানের কানসাই পেইন্ট বাংলাদেশের আরএকে পেইন্টস-এ ২০১৮ সালে বিনিয়োগ করে যখন দেশের প্রধান পেইন্ট কোম্পানী বার্জার পেইন্টস জাপানের সুগুকো পেইন্টস-এর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করে মেরিন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেইন্ট তৈরী ও বাজারজাত করার জন্য।

আবার বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেইন্ট কোম্পানী এশিয়ান পেইন্টস মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে তাদের দ্বিতীয় কারখানার উৎপাদন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ২০২১-এর জুলাইতে। তারা এ কারখানা তৈরীর কাজ শুরু করে ২০২০ এর জানুয়ারীতে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০টি পেইন্ট কোম্পানী ব্যবসা করে। যাদের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারারস এসোসিয়েশন – বিপিএমএ। সবচেয়ে বেশি মার্কেট শেয়ার নিয়ে নেতৃস্থানে আছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড। যার মার্কেট শেয়ার প্রায় ৫০%। আবার বার্জার, এশিয়ান, নিপ্পন, নেরোল্যাক, ডুলাক্স প্রমুখ বিদেশী পেইন্ট কোম্পানীদের দখলে বাংলাদেশের প্রায় ৮০%-এর বেশী মার্কেট শেয়ার।

বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারারস এসোসিয়েশন (বিপিএমএ) – এর তথ্যমতে, বার্জার পেইন্টসের মার্কেট শেয়ারের পর এশিয়ান পেইন্টস-এর শেয়ার (১৮%), দেশীয় কোম্পানী রক্সি ও এলিট পেইন্ট ৭% করে এবং পেইলাক ৫% ও রক্সি পেইন্ট ২%। অন্যান্য ৩০টি কোম্পানীর মধ্যে রেইনবো পেইন্ট, কানসাই, নিপ্পন, ডুলাক্স, উজালা পেইন্ট ১১% মার্কেট শেয়ারে অপারেট করছে।

বাংলাদেশের পেইন্ট মার্কেট সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পেইন্ট কোম্পানীগুলোর নজরে এসেছে। জাপানের কানসাই পেইন্টের সহযোগী ভারতীয় কানসাই নেরোল্যাক-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আরএকে পেইন্টস-এ ২০১৮ সালে প্রায় ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোম্পানীর ৫৫% অংশের মালিকানা নেয়। “বাংলাদেশে ব্যাবসা শুরু করার জন্য আমরা একটা ভাল ও নিয়মানুবর্তী কোম্পানী দেখছিলাম, কারন জাপানের মানুষ স্বচ্ছতা পছন্দ করে। এজন্যই আমরা আরএকে পেইন্টস-কে পছন্দ করেছি” কানসাই নেরোল্যাক পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার ভিশাল এন মুথরেজা বলেছেন।

গত জানুয়ারি ২০২০-এ বার্জার পেইন্টস জাপানের সুগুকো মেরিন পেইন্টস (CMP)-এর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করে মেরিন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেইন্ট তৈরী ও বাজারজাত করার জন্য। এচুক্তির আলোকে বার্জার পেইন্টস মেরিন পেইন্টস ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেইন্টস উৎপাদন ও মার্কেটিং – এ সহযোগিতা পাবে। বার্জার পেইন্টসই হবে দেশে প্রথম আন্তর্জাতিকমানের মেরিন পেইন্ট প্রস্তুতকারী ও মার্কেটার।

আরো পড়ুনঃ বেসামাল দাম: রড-সিমেন্টের সব তথ্য তলব

বার্জার পেইন্টস ইতিমধ্যে সুইডেনের বেকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোটিংস হোল্ডিং এবং বৃটিশ ফসরক ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে দু’টি আলাদা জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানী গঠন করে যথাক্রমে ‘বার্জার বেকার বাংলাদেশ লিমিটেড’ ও বার্জার ফসরক লিমিটেড’। বার্জার বেকার আমদানী নির্ভর কালার কোটেড টিনের জন্য স্থানীয়ভাবে রঙ প্রস্তুত করে আবার বার্জার ফসরক বিভিন্ন স্থাপনার জন্য কন্সট্রাকশন কেমিক্যাল তৈরীর জন্য নারায়ণগঞ্জে কারখানা স্থাপন করছে।

বার্জার পেইন্টস দেশের সবচেয়ে বড় পেইন্ট কোম্পানী। যার মার্কেট শেয়ার প্রায় ৫০%। এটি ১৯৭০ সাল থেকে – পাকিস্তান আমল থেকে – এদেশে পেইন্ট প্রস্তুত ও বাজারজাত করে আসছে। এটি দেশের পুরানা কোম্পানীদের অন্যতম। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে তাদের কারখানা অবস্থিত। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর মিরসরাই-তে তাদের তৃতীয় কারখানার জন্য প্রায় ৫০ একর জমি নিয়েছে।

“দেশের পেইন্ট কনসাম্পশন এখন ১৮০,০০০ টনের বেশী। দেশের বিপুল জনসংখ্যা ও নগরায়নের কারনে এই সেক্টর গত দশকে, বছরের পর বছর, ৬%শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। প্লাস্টিক ইমালশন, ডিস্টেম্পার, এক্সটেরিয়র ইমালশন ও এনামেল পেইন্টই এ বাজারের প্রধানতম পন্য। প্লাস্টিক ও ডিস্টেম্পার একে অপরের পরিপুরক। রঙ করা এখন সারা দেশে শহরের ঘর – বাড়ীর দেয়ালের সাথে সাথে গ্রাম অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।“ বলেছেন বার্জার পেইন্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রূপালী চৌধুরী।

এশিয়ান পেইন্টস ইন্ডিয়ার সাবসিডিয়ারী হল এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেইন্ট কোম্পানী যাদের ১৮% মার্কেট শেয়ার আছে। ঢাকার কাছে গাজিপুরে তাদের পেইন্ট কারখানা। আবার ২০২০ সালে তারা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর মিরসরাই-তে দ্বিতীয় কারখানার কাজ শুরু করে। এতে তারা প্রায় ১৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে যাতে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুন করা যায়। ২০২১ সালের মধ্যেই তারা উৎপাদনে যেতে চায়। ২০ একর জায়গায় স্থাপিত এই কারখানায় তারা প্রথমেই ৩০,০০০ টন পেইন্ট ও সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে।

0