যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ: ব্যয় বাড়ছে ৭ হাজার কোটি টাকা


যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ: ব্যয় বাড়ছে ৭ হাজার কোটি টাকা

যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি তিন বছরে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে ব্যয় হয়েছে ২১৯ কোটি ১২ লাখ টাকা।

একই সময়ে প্রকৃত অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা। ফলে প্রকল্পের মোট ব্যয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রকল্পের ব্যয়ই নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন জাদুঘর নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের প্রস্তাবিত ব্যয়, প্রকল্পের অধীনে পরামর্শকদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় সম্পর্কে প্রশ্ন করবে এবং ব্যাখ্যা চাইবে। আগামী রোববার প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব করা রাষ্ট্রীয় তহবিল উভয়ই নষ্ট করবে এবং জাতিকে সময়মত প্রকল্পের সুবিধাগুলি কাটাতে বাধা দেবে। এর সঙ্গে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ।

তবে খরচ বাড়ার কথা বলতে নারাজ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন। তিনি যুগান্তরকে জানান, প্রথম ধাপে সম্ভাব্য খরচ আনুমানিক করা হলেও  এখন প্রকৃত খরচ দরপত্রের মূল্য অনুযায়ী ধরা হছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

প্রকল্পের বাস্তবায়ন এখনও শুরু না হলে খরচ বাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিন আরো বলেন, যারা প্রস্তাব দিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই প্রকল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ব্যয়ের হিসাব করেছেন। তবে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুসরণ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি কোনো জাদুঘর নয়, প্রতিটি বড় প্রকল্পের আর্কাইভ করা আছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রয়েছে।

তাই রেলওয়ে সেতুর মতো বড় প্রকল্পের আর্কাইভ থাকা স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো এতটাই সংকটাপন্ন ও বিলম্বিত যে সেগুলোর মেয়াদ বাড়ছে এবং খরচও বাড়ছে। এর পেছনে রয়েছে দুর্বল বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনাসহ অনেক বিষয়।

এক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ অপচয় হয়, যার ফলে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। এই প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্নের উত্তর না পেলে কোনো অনুমোদন দেওয়া হবে না। পরিকল্পনা কমিশনকে রোল মডেল হতে হবে। তিন বছর আগের প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু না হলে এর দায় সংশ্লিষ্টদের। এর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে ঋণের আর্থিক বোঝা দিনের পর দিন জনগণের ওপর চাপতে থাকবে।

রোববারের পিইসি সভার জন্য তৈরি কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য- প্রকল্পের পরিধির মধ্যে সিভিল কাজের দরপত্রের প্যাকেজ ১ ও প্যাকেজ ২-এর দাম বেড়েছে। এ ছাড়া সিডি ভ্যাটের হার ও পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। নতুন উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য ফ্যাসিলিটি ভাড়ার সংস্থান।

এ ছাড়া ব্যয় বেড়েছে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে সেতু এলাকায় জাদুঘর নির্মাণের ব্যয়, ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সির।। আর মেয়াদ দীর্ঘ হওয়ার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটে শ্রম ও অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়বে। এছাড়াও, মুদ্রা বিনিময়, সিগন্যালিং এবং টেলিকমিউনিকেশনের কাজ (প্যাকেজ ৩) এবং ব্যাঙ্কের চার্জও বাড়বে।

ওয়ার্কিং পেপার অনুসারে, বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত প্রকল্পের প্রথম সংশোধন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শের ক্ষেত্রে ব্যয় হ্রাস এবং বিস্তারিত পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ পরামর্শের ক্ষেত্রে ব্যয় হ্রাসের কারণে। কমিশনের তথ্যমতে, নকশা ও তদারকি পরামর্শ খাতে সরকারি তহবিলের ২১২ কোটি টাকাসহ সংশোধিত প্রকল্পের জন্য মোট ৮১৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার, ব্যবস্থাপনা সহায়তা পরামর্শদাতাদের জন্য সরকারী তহবিল থেকে ৫২ কোটি টাকার বরাদ্দ করা হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালটেন্টের কাজ কী? এ ছাড়া, দেশি-বিদেশি পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ পরামর্শক ব্যবহারের পরেও ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালট্যান্টের প্রয়োজন আছে কি না তাও মিটিংয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে।

কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের জন্য মোট ৩৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি অনুমোদিত মূল প্রকল্প প্রস্তাবে ছিল না।এই জমির মালিকানা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, একটি সরকারি সংস্থা। এই খরচের জন্য ছাড় দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।

প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজের জন্য একটি বিশদ খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। এ অবস্থায় দাম ও জরুরী অবস্থার জন্য ১২২ কোটি টাকার অতিরিক্ত সম্পদ প্রয়োজন হলে তা আবার যাচাই করা যেতে পারে। প্রকল্প প্রস্তাব প্যাকেজ-ভিত্তিক ব্যয় এবং মূল্য বৃদ্ধি, সেইসাথে শারীরিক আতঙ্কের জন্য প্রদান করে। আবার, সামগ্রিক মূল্য এবং শারীরিক আকস্মিক সম্পদ আছে.

এই বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একই ধরণের কাজের জন্য দুটি জায়গায় বরাদ্দের প্রয়োজন হয় না। পিআইইউ সেক্টরের অন্যান্য ইনপুট এলাকায় বিভিন্ন অঙ্গের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ বোধগম্য নয়। এ খাতে ১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা অনুমোদিত প্রস্তাবে পূর্বাভাস ছিল না। এটার একটা ব্যাখ্যা দরকার। এ ছাড়া এ খাতে অতিরিক্ত চার কোটি টাকা ব্যয়েরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

পরামর্শক খাতে সার্বিকভাবে ২৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এছাড়াও ইমপ্লয়ারসের ফি বাবদ ১ কোটি এবং অনারিয়াম ফর আদারসফি বাবদ ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা  প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তিন বছরের মধ্যে কেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, তা আগে খতিয়ে দেখতে হবে। অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

যদি না হয়, আপনি দেখতে পাবেন যে সংশোধনের পরে সময়কাল এবং খরচ আবার বাড়তে পারে। বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের যৌক্তিক ব্যাখ্যা না দিলে অনুমোদন বন্ধ করা উচিত। কারণ জনগণের কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই টাকার ভার জনগণকেই বহন করতে হবে।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ প্রকল্প সময়মতো শেষ হয় না। তা কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সময়মতো প্রকল্প শেষ না হলে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচও বেড়ে যায়। প্রকল্প থেকেও কাঙ্খিত সুবিধা পাওয়া যায় না। এটা ঠিক না।

ঢাকায় বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ ছাড়া প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো ঠিক নয়। এ প্রকল্পে জাদুঘর ভবন, খাতে বিশেষ ব্যয়ের বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এডিবি-র অর্থায়নে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েলগেজ একক রেল সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হবে।

পরবর্তীতে জাপান কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের অংশ হিসেবে আরেকটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। পরবর্তীতে জাপান-বাংলাদেশ কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপের আওতায় যৌথ বিবৃতিতে যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় এই প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হয়।

জাপানি গবেষণায় ট্রাস্ট ব্রিজ বা হেভি লোডেড ​​সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নলাকার স্টিলের সিট-পাইল ফাউন্ডেশন এবং স্টিলের গার্ডার দিয়ে সেতুটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে, ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) মোট ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করে। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ২ হাজার ৯ কোটি ৭৪ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা ছিল।

এ সময় মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ সময়সীমা এখন ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন ২০২৫ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় ৩০০ মিটার উজানে যমুনা নদীর ওপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল ট্র্যাক রেলওয়ে সেতু নির্মাণের জন্য ৯ জানুয়ারি প্রকল্পের মন্ত্রিসভা প্রকিউরমেন্ট কমিটি দুটি প্যাকেজের বিডিং অনুমোদন দিয়েছে।


আরো পড়ুনঃবাড়ছে রডের দাম, প্রতি টন ১০,৯২৫ টাকা

0