ধুঁকছে সিমেন্ট খাত
ধুঁকছে সিমেন্ট খাত
স্বপ্নের পদ্মা সেতু, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মেট্রোরেলসহ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, আবাসন খাত ও গ্রামে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণের ওপর ভর করে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে। মহামারি করোনার দুঃসময়েও সিমেন্ট খাত প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি সময়ের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব তছনছ করে দিয়েছে। যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ; তাও আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। দাম বাড়িয়েও ধুঁকছে সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
একাধিক কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা পর্যায়ে এখন ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম কোম্পানিভেদে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪০ থেকে ৫৬০ টাকা। এক বছর আগে এ দাম ছিল ৪৪০ থেকে ৪৮০ টাকা।
সিমেন্টশিল্পের কাঁচামালের শতভাগই আমদানিনির্ভর। সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। কাঁচামাল আমদানির তথ্য দিয়ে সিমেন্ট উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টন সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। কাঁচামালের আমদানি কমলেও খরচ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এই অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১৫৪ কোটি ডলারের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৪০টি প্রতিষ্ঠান (একই গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ) এ কাঁচামাল আমদানি করেছে। কোম্পানিভেদে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি বাড়লেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই আমদানি কমেছে।
সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির নেতারা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নানামুখী সংকটের কারণে সিমেন্টশিল্পে ক্রান্তিকাল দেখা দিয়েছে। এ কারণে সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ ঋণাত্মক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়নকাজ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে গেছে। তাতে সিমেন্টের বিক্রিও কমে গেছে।
সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের শেষে দেশে সিমেন্টের বাজার ছিল প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে এ বাজারের আকার বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সাল শেষে দেশের সিমেন্টের বাজার ছিল ২০ হাজার কোটি টাকার।
মুনাফা কমেছে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলো ফ্লোর প্রাইসের কারণে নড়াচড়া করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার আরোপিত ফ্লোর প্রাইসের কারণে সিমেন্ট খাতের সাতটি কোম্পানির শেয়ারদর আটকে আছে এক জায়গাতেই। এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো হচ্ছে- কনফিডেন্স সিমেন্ট, ক্রাউন সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, আরামিট সিমেন্ট, লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট, মেঘনা সিমেন্ট এবং প্রিমিয়ার সিমেন্ট।
করোনা মহামারির ধাক্কা তারপর শুরু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই দুই বৈশ্বিক সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ বড় প্রভাব পড়েছে। যা থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। অন্য সবকিছুর মতোই দেশের পুঁজিবাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। তার ওপর যোগ হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বেঁধে দেয়া ফ্লোর প্রাইস।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে আরামিট সিমেন্টের শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৬০ পয়সা। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে এ আয় গিয়ে দাঁড়ায় লোকসানে। উদ্বেগজনকভাবে এক বছর পর কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান বেড়ে যায়। ২০২২ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১৬ টাকা ৮৮ পয়সা। লোকসানের কারণে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণও কমিয়ে দেয়। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও গত বছর তা কমিয়ে ৫ শতাংশ করে দেয়।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি আয় করে ৬ টাকা ১৮ পয়সা। কিন্তু ২০২০ সালে আয়ের বদলে উল্টো লোকসান করে কোম্পানিটি। ২০২২ সালে সব সময় মুনাফা করা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১০ টাকা ৭০ পয়সা।
ক্রাউন সিমেন্টের শেয়ারপ্রতি আয় হয় ২০২১ সালে ৫ টাকা ৭৯ পয়সা। কিন্তু এ আয় কমে উল্টো লোকসান হয় কোম্পানিটির। গত বছর শেয়ারপ্রতি ঘাটতি হয় ১ টাকা ৫৪ পয়সা। এতে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণও কমিয়ে দেয়। ২০২১ সালে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল ২০ শতাংশ। এরপরের বছর তা কমিয়ে দেয় ১০ শতাংশ।
কনফিডেন্স সিমেন্ট ২০২১ সালে ১৫ টাকা ৮৬ পয়সা শেয়ারপ্রতি আয় করলেও এরপরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন ক্লোজিংয়ে শেয়ারপ্রতি আয় কমে দাঁড়ায় ১ টাকা ৪৩ পয়সায়। যার প্রভাব পড়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বিতরণে। ২০২১ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দেয় ২৫ শতাংশ। কিন্তু আয় কমে যাওয়ায় কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণও কমিয়ে দেয়। গত বছর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়।
মেঘনা সিমেন্টের আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ২০২১ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয় ২ টাকা ৭৩ পয়সা। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ গত বছর এ আয় কমে দাঁড়ায় ১ টাকা ৯৫ পয়সায়। আয় কমলেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণ কমায়নি। ২০২১ সালে ও গত বছর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ করে নগদের পাশাপাশি বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করেছে।
গত বছরের ২৮ জুলাই সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় বিএসইসি। ফলে একটি কোম্পানির শেয়ার নির্দিষ্ট একটা সীমার পরে আর কমে না, যার প্রমাণ মেলে দৈনিক লেনদেনের দিকে তাকালে। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর হাতবদল হয় ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকার শেয়ার, গত ২ বছর ৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর প্রিমিয়ার সিমেন্টের শেয়ারদর ছিল ৩১ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর তা কমতে কমতে আসে ২১ টাকা ৭০ পয়সায়, যা সর্বশেষ ৬ মার্চ লেনদেন হয় ২৩ টাকা ৭০ পয়সায়।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু লোকসান করা প্রতিষ্ঠান না। তাহলে আমরা লোকসান কেন করলাম? কারণ একটাই, ডলারের দাম বৃদ্ধি।’ তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী যেটা প্রভিশন করার কথা, আমরা পুরো টাকাটা প্রভিশন করেছি। যেটা অনেক কোম্পানি করে না। এটাও লোকসানের একটা কারণ। তার সঙ্গে ডলারসংকট তো আছেই।’
বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায় দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এক বছর আগে ডলারের রেট ছিল ৮৬ টাকা আর এখন পেমেন্ট করতে হচ্ছে ১০৬ থেকে ১১০ টাকায়। পাশাপাশি সরকার ৩০ শতাংশ ডিউটি বাড়িয়েছে সিমেন্টের কাঁচামাল লাইমস্টোনের ওপর। এসব কারণে সিমেন্টের দাম বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ৩০ বছরের মধ্যে সিমেন্ট খাত এখন ভয়াবহ এক সংকটের মুখোমুখি। বিশ্ববাজারে কাঁচামাল, পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বাড়তি জ্বালানি খরচ। এত সব সংকটের মধ্যে পড়ে লোকসান কমাতে সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়েছে। কারণ লোকসান কাটাতে মূল্য সমন্বয়ের বিকল্প কোম্পানিগুলোর সামনে নেই।’
তিনি বলেন, জাহাজ ও ট্রাক ভাড়া আগের তুলনায় ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না। এসব কারণে সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা দুশ্চিন্তায় আছেন।’ এ সংকট কবে কাটবে তার কোনো আশা দেখছেন না শংকর কুমার।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর খারাপ অবস্থা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির ভালো-খারাপের নানা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কমিশন (বিএসইসি) কেন ফ্লোর প্রাইস দিয়েছে? সূচক পড়ে গেলে তার জন্য কমিশন দায়ী নয়, সেটা ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের ব্যাপার। সূচকের পড়তির ব্যাপারে কমিশনের এত দুশ্চিন্তা কেন? এখন তো বাজার অচল।
আরো পড়ুনঃসিমেন্ট ব্যবসায়ীদের দাবি ডলার ব্যবসা করে ব্যাংক খাত সবচেয়ে ভালো আছে
0