সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনে নৌপথই একমাত্র ভরসা
সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনে নৌপথই একমাত্র ভরসা
দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে বছরে সাড়ে সাত কোটি টনেরও বেশি কার্গো পণ্য পরিবহন করা হয়। এসবের অর্ধেকের বেশি আমদানি পণ্য। নৌ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এসব পণ্য পৌঁছে যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। পরিবহন করা এসব পণ্যের ৪৭ শতাংশ সিমেন্ট উৎপাদনে অপরিহার্য উপাদান ক্লিংকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সুবিধাজনক ও ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় ক্লিংকার পরিবহনে নৌপথের ওপর ভরসা এ খাতের আমদানিকারকদের।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘মুভিং ফরোয়ার্ড: কানেক্টিভিটি অ্যান্ড লজিস্টিকস টু সাসটেইন বাংলাদেশ’স সাকসেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলছে, নৌপথ ব্যবহার করে পরিবহন করা প্রায় ৭ কোটি ৬০ লাখ টন পণ্যের ৬১ শতাংশই আমদানি পণ্য। আর এসব আমদানি পণ্যের দুই-তৃতীয়াংশ ক্লিংকার, সার ও গম। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে কয়লা, ফ্লাই অ্যাশ, চিনি, ভোজ্যতেল ও অন্যান্য পণ্য যেমন—লবণ, স্টিল স্ক্র্যাপ, সিরামিক সেন্ড, জিপসাম ও পাথর। পরিবহন করা পণ্যের ৪৭ শতাংশ ক্লিংকার। এছাড়া অবশিষ্ট পণ্যের মধ্যে গম ১২ শতাংশ, সার ৭, কয়লা ৬, চিনি ৫, ভোজ্যতেল ৪ এবং অন্যান্য ১৪ শতাংশ।
লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক তৌহিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ক্লিংকার অনেক ওজনের একটি পণ্য। এ কারণে সড়কপথে এটি পরিবহন করা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে সড়কে ক্লিংকার বহন করা হলে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের মূল্য বর্তমানের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি পড়বে। এছাড়া সড়কের তুলনায় নৌপথে ক্লিংকার বহন তুলনামূলক নিরাপদ ও সুবিধাজনক। তাই নদীপথে ক্লিংকার পরিবহনে সিমেন্ট উৎপাদকরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯-এর পরিসংখ্যান বলছে, আট বছর ধরে দেশে ক্লিংকার আমদানি বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের সিমেন্ট উৎপাদকরা ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার মূল্যের ক্লিংকার আমদানি করে, যেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) সাত মাসে ক্লিংকার আমদানির পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে ক্লিংকারের আমদানি বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি হারে।
জানা গেছে, আমদানি করা ক্লিংকারের প্রায় পুরোটাই (৮০ শতাংশ) ব্যবহার করা হয় সিমেন্ট উৎপাদনে। খনিজ সম্পদের ঘাটতির কারণে প্রয়োজনীয় ক্লিংকার ও লাইমস্টোন এবং সিমেন্ট উৎপাদনের অন্য কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশের ৩২টি সিমেন্ট উৎপাদক কোম্পানি। অধিকাংশ সিমেন্ট উৎপাদক ক্লিংকারের পাশাপাশি জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ ও আয়রন স্লেগ প্রতিবেশী ভারত, চীন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন থেকে আমদানি করে। সিমেন্ট উৎপাদনের প্রধান কারখানাগুলো দেশের বিভিন্ন নদীর তীরে অবস্থিত। এ কারণে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের জন্য আমদানি করা কাঁচামাল নদী তীরবর্তী নিজস্ব জেটিতে খালাস করা সুবিধাজনক। ঢাকা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট কারখানার অবস্থান যেগুলো জাতীয় উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ করে থাকে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে সারের চাহিদার সিংহভাগই আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়। এসব সার আমদানির একমাত্র মাধ্যম হলো নৌপথ।
ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত সিমেন্ট কারখানাগুলো চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ক্লিংকার আমদানি করে। তবে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত কারখানাগুলো ক্লিংকার আমদানির জন্য ব্যবহার করে মোংলা বন্দর। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে দুই কোটি টন ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ২০ লাখ টন ক্লিংকার আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে আমদানি করা ক্লিংকারের ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথে ঢাকা অঞ্চলে পরিবহনের জন্য মূলত বার্জ ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নেয়া হয় চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তিগত জেটিতে। অন্যদিকে মোংলা বন্দরে আনা ক্লিংকার খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন সিমেন্ট কারখানার জেটিতে নেয়া হয়।
নৌপথে পণ্য পরিবহন বিষয়ে গালফ ওরিয়েন্ট সি ওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাহফুজ হামিদ বলেন, সড়কের তুলনায় শিল্প ও উৎপাদনশীল খাতের কাঁচামাল বহনে নৌপথে খরচ তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এছাড়া নৌ-পরিবহনে পণ্য সবচেয়ে নিরাপদে পৌঁছানো সম্ভব। বার্জে পণ্য পরিবহনে অপচয়ও কম হয়। ফলে পণ্য পরিবহনে নৌপথ সবচেয়ে সুবিধাজনক ও ব্যয়সাশ্রয়ী।
উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্গো পরিবহন হলেও অভ্যন্তরীণ নৌপথে সে অনুপাতে কনটেইনার বহন করা হয় না। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে পরিবহন করা হয় ১ লাখ ৪০ হাজার কনটেইনার। যেগুলোর প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানি পণ্য। অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে দেশের ভেতর স্থানীয়ভাবে যেসব পণ্য পরিবহন করা হয় সেগুলোর অন্যতম নির্মাণসামগ্রী, সিমেন্ট, পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্য ও সার। নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে বালি ও পাথর।
অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে যেসব আমদানি পণ্য পরিবহন করা হয় তাদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি পণ্য আসে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, আমদানি করা পণ্যের ৭৯ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর, ১৫ শতাংশ মোংলা বন্দর এবং অবশিষ্ট ৬ শতাংশ ভারতের কলকাতা হয়ে দেশে প্রবেশ করে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৭ কোটি ৩০ লাখ টন আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং হয়। এর মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন পণ্য পরিবহনের জন্য বেছে নেয়া হয় অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্ক।
আরো পড়ুনঃপদ্মা সেতুর ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি পরিশোধ
0